Tuesday, October 22, 2013

সৎপাত্র - (Satpatra)

শুনতে পেলুম পোস্তা গিয়ে-
তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে ?
গঙ্গারামকে পাত্র পেলে ?
জান্‌‌তে চাও সে কেমন ছেলে ?

মন্দ নয় সে পাত্র ভাল-
রঙ যদিও বেজায় কালো ;
তার উপরে মুখের গঠন
অনেকটা ঠিক প্যাঁচার মতন ।

বিদ্যে বুদ্ধি ? বলছি মশাই-
ধন্যি ছেলের অধ্যবসায় !
উনিশটি বার ম্যাট্রিকে সে
ঘায়েল হয়ে থাম্‌ল শেষে ।

বিষয় আশয় ? গরীব বেজায়-
কষ্টে-সৃষ্টে দিন চলে যায় ।
মানুষ ত নয় ভাই গুলো তার-
একটা পাগল একটা গোঁয়ার ;
আরেকটি সে তৈরি ছেলে,
জাল ক'রে নোট্‌ গেছেন জেলে ।
কনিষ্ঠটি তব্‌লা বাজায়
যাত্রাদলে পাঁচ টাকা পায় ।

গঙ্গারাম ত কেবল ভোগে
পিলের জ্বর আর পাণ্ডু রোগে ।
কিন্তু তারা উচচ ঘর 
কংসরাজের বংশধর !
শ্যাম লাহিড়ী বনগ্রামের 
কি যেন হয় গঙ্গারামের ।-

যাহোক্‌, এবার পাত্র পেলে,
এমন কি আর মন্দ ছেলে ?
Read More...

Wednesday, July 24, 2013

গানের গুঁতো - (Ganer Guto)

গান জুড়েছেন গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা
আওয়াজখানা দিচ্ছে হানা দিল্লী থেকে বর্মা ! 
গাইছে ছেড়ে প্রাণের মায়া, গাইছে তেড়ে প্রাণপণ, 
ছুট্‌‌ছে লোকে চারদিকেতে ঘুরছে মাথা ভন্‌ ভন্‌ । 

মরছে কত জখম হয়ে কর্‌ছে কত ছট্‌ফট্‌- 
বলছে হেঁকে, "প্রাণটা গেল, গানটা থামাও ঝট্‌ পট্‌ ।" 
বাঁধন-ছেড়া মহিষ ঘোড়া পথের ধারে চিৎপাত ; 
ভীষ্মলোচন গাইছে তেড়ে নাইকো তাহে দৃক্‌পাত । 

চার পা তুলি জন্তুগুলি পড়্‌‌ছে বেগে মুর্ছায়, 
লাঙ্গুল খাড়া পাগল পারা বল্‌‌ছে বেগে, "দূর ছাই" । 
জলের প্রানী অবাক মানি গভীর জলে চুপ চাপ, 
গাছের বংশ হ'চ্ছে ধ্বংস পড়্‌ছে দেদার ঝুপ্ ঝাপ্‌ । 

শুন্য মাঝে ঘূর্ণা লেগে ডিগবাজি খায় পক্ষী, স
বাই হাঁকে, 'আর না দাদা, গানটা থামাও লক্ষ্মী ।" 
গানের দাপে আকাশ কাঁপে দালান ফাটে বিল্‌কুল্‌ 
ভীষ্মলোচন গাইছে ভীষণ খোশ্‌‌মেজাজে দিল্‌ খুল্‌ । 

এক যে ছিল পাগলা ছাগল, এম্‌‌নি সেটা ওস্তাদ, 
গানের তালে শিং বাগিয়ে মারলে গুঁতো পশ্চাৎ । 
আর কোথা যায় একটি কথায় গানের মাথায় ডাণ্ডা 
'বাপরে' ব'লে ভীষ্মলোচন এক্কেবারে ঠাণ্ডা ।
Read More...

একুশে আইন - (Ekushe Aein)


শিবঠাকুরের আপন দেশে,
আইন কানুন সর্বনেশে !
কেউ যদি পা পিছলে প'ড়ে,
প্যায়দা এসে পাক্‌‌ড়ে ধরে,
কাজির কাছে হয় বিচার-
       একুশ টাকা দণ্ড তার ।।

সেথায় সন্ধে ছটার আগে
হাঁচ্‌‌তে হ'লে টিকিট লাগে
হাঁচ্‌‌লে পরে বিন্‌ টিকিটে
দম্‌দমাদম্‌ লাগায় পিঠে,
কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে-
       একুশ দফা হাঁচিয়ে মারে ।।

কারুর যদি দাঁতটি নড়ে,
চারটি টাকা মাশুল ধরে,
কারুর যদি গোঁফ গজায়,
একশো আনা ট্যাকসো চায়-
খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়,
       সেলাম ঠেকায় একুশ বার।।

চল্‌‌তে গিয়ে কেউ যদি চায়
এদিক্‌ ওদিক্‌ ডাইনে বাঁয়,
রাজার কাছে খবর ছোটে,
পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,
দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায়
       একুশ হাতা জল গেলায়।।

যে সব লোকে পদ্য লেখে,
তাদের ধ'রে খাঁচায় রেখে,
কানের কাছে নানান্‌ সুরে
নামতা শোনায় একশো উড়ে,
সামনে রেখে মুদির খাতা-
       হিসেব কষায় একুশ পাতা।।

হঠাৎ সেথায় রাত দুপুরে
নাক ডাকালে ঘুমের ঘোরে,
অম্‌নি তেড়ে মাথায় ঘষে,
গোবর গুলে বেলের কষে,
একুশটি পাক ঘুরিয়ে তাকে
       একশ ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখে।।

Read More...

আবোল তাবোল (Abol Tabol)

এক যে ছিল রাজা
(থুড়ি, রাজা নয় সে ডাইনি বুড়ি) ! 
তার যে ছিল ময়ূর
- (না না, ময়ূর কিসের ? ছাগল ছানা) ।
 উঠানে তার থাক্‌ত পোঁতা
-(বাড়িই নেই, তার উঠান কোথা) ? 
শুনেছি তাত পিশতুতো ভাই
-(ভাই নয়ত, মামা-গোঁসাই ) । 
বল্‌ত সে তার শিষ্যটিরে
-(জন্ম-বোবা বলবে কিরে) । 
যা হোক, তারা তিনটি প্রানী
-(পাঁচটি তারা, সবাই জানি !) 
থও না বাপু খ্যাঁচাখেচি 
(আচ্ছা বল, চুপ করেছি) ।। 
তারপরে যেই সন্ধ্যাবেলা, 
যেম্নি না তার ওষুধ গেলা, অম্‌নি তেড়ে জটায় ধরা
-(কোথায় জটা ? টাক যে ভরা !) 
হোক্‌ না টেকো তোর তাতে কি ? 
গোমরামুখো মুখ্যু ঢেঁকি ! 
ধরব ঠেসে টুটির পরে পিট্‌ব তোমার মুণ্ডু ধরে । 
এখন বাপু পালাও কোথা ? 
গল্প বলা সহজ কথা ? 
Read More...

অবাক জলপান - (Obak Jolpan)

[ ছাতা মাথায় এক পথিকের প্রবেশ, পিঠে লাঠির আগায় লোট-বাঁধা পুঁটলি, উস্কোখুস্কো চুল্, শ্রান্ত চেহারা ]
পথিক :   নাঃ ‒ একটু জল না পেলে আর চলছে না । সেই সকাল থেকে হেঁটে আসছি, এখন‌‌ও প্রায় এক ঘণ্টার পথ বাকি । তেষ্টায় মগজের ঘিলু শুকিয়ে উঠল । কিন্তু জল চাই কার কাছে ? গেরস্তের বাড়ি দুপুর রোদে দরজা এঁটে সব ঘুম দিচ্ছে, ডাকলে সাড়া দেয় না । বেশি চেঁচাতে গেলে হয়তো লোকজন নিয়ে তেড়ে আসবে । পথেও ত লোকজন দেখছিনে ।‒ ঐ একজন আসছে ! ওকেই জিজ্ঞেস করা যাক ।
[ ঝুড়ি মাথায় এক ব্যক্তির প্রবেশ ]
পথিক :   মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন ?
ঝুড়িওয়ালা :   জলপাই ? জলপাই এখন কোথায় পাবেন ? এ ত জলপাইয়ের সময় নয় । কাঁচা আম নিতে চান দিতে পারি‒
পথিক :   না না, আমি তা বলিনি‒
ঝুড়িওয়ালা :   না, কাঁচা আম আপনি বলেননি, কিন্তু জলপাই চাচ্ছিলেন কিনা, তা ত আর এখন পাওয়া যাবে না, তাই বলছিলুম‒
পথিক :   না হে আমি জলপাই চাচ্ছিনে‒
ঝুড়িওয়ালা :   চাচ্ছেন না ত 'কোথায় পাব' 'কোথায় পাব' কচ্ছেন কেন ? খামকা এরকম করবার মানে কি ?
পথিক :   আপনি ভুল বুঝেছেন‒ আমি জল চাচ্ছিলাম‒
ঝুড়িওয়ালা :   জল চাচ্ছেন তো 'জল' বললেই হয়‒ 'জলপাই' বলবার দরকার কি ? জল আর জলপাই কি এক হল ? আলু আর আলুবোখরা কি সমান ? মাছও যা মাছরাঙাও তাই ? বরকে কি আপনি বরকন্দাজ বলেন ? চাল কিনতে এসে চালতার খোঁজ করেন ?
পথিক :   ঘাট হয়েছে মশাই । আপনার সঙ্গে কথা বলাই আমার অন্যায় হয়েছে ।
ঝুড়িওয়ালা :   অন্যায় তো হয়েছেই । দেখছেন ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছি‒ তবে জল‌‌ই বা চাচ্ছেন কেন ? ঝুড়িতে করে কি জল নেয় ? লোকের সঙ্গে কথা ক‌‌ইতে গেলে একটু বিবেচনা করে বলতে হয় ।
পথিক :   দেখলে ! কি কথায় কি বানিয়ে ফেললে ! যাক, ঐ বুড়ো আসছে, ওকে একবার বলে দেখি ।
[ লাঠি হাতে, চটি পায়ে চাদর গায়ে এক বৃদ্ধের প্রবেশ ]
বৃদ্ধ :   কে ও ? গোপ্‌‌লা নাকি ?
পথিক :   আজ্ঞে না, আমি পুবগাঁয়ের লোক‒ একটু জলের খোঁজ কচ্ছিলুম‒
বৃদ্ধ :   বল কিহে ? পুবগাঁও ছেড়ে এখেনে এয়েছ জলের খোঁজ করতে ? ‒ হাঃ, হাঃ, হাঃ । তা, যাই বল বাপু, অমন জাল কিন্তু কোথাও পাবে না । খাসা জল, তোফা জল, চমৎ‌কা-র-র জল ।
পথিক :   আজ্ঞে হাঁ, সেই সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেজায় তেষ্টা পেয়ে গেছে ।
বৃদ্ধ :   তা ত পাবেই । ভালো জল যদি হয়, তা দেখলে তেষ্টা পায়, নাম করলে তেষ্টা পায়, ভাবতে গেলে তেষ্টা পায় । তেমন তেমন জাল ত খাওনি কখনো ! - বলি ঘুম্‌‌ড়ির জল খেয়েছো কোনোদিন ?
পথিক :   আজ্ঞে না, তা খাইনি-
বৃদ্ধ :   খাওনি ? অ্যাঃ ! ঘুম্‌‌ড়ি হচ্ছে আমার মামাবাড়ি‒ আদত জলের জায়গা । সেখানকার যে জল, সে কি বলব তোমায় ? কত জল খেলাম‒ কলের জল, নদীর জল, ঝরণার জল, পুকুরের জল‒ কিন্তু মামাবাড়ির কুয়োর যে জল, অমনটি আর কোথাও খেলাম না । ঠিক যেন চিনির পানা, ঠিক যেন কেওড়া-দেওয়া সরবৎ‌ !
পথিক :   তা মশাই আপনার জল আপনি মাথায় করে রাখুন‒ আপাতত এখন এই তেষ্টার সময়, যা হয় একটু জল আমার গলায় পড়লেই চলবে‒
বৃদ্ধ :   তাহলে বাপু তোমার গাঁয়ে বসে জল খেলেই ত পারতে ? পাঁচ ক্রোশ পথ হেঁটে জল খেতে আসবার দরকার কি ছিল ? 'যা হয় একটা হলেই হল' ও আবার কি রকম কথা ? আর অমন তচ্ছিল্য করে বলবারই বা দরকার কি ? আমাদের জল পছন্দ না হয়, খেও না- বাস্‌‌ । গায়ে পড়ে নিন্দে করবার দরকার কি ? আমি ওরকম ভালোবাসিনে । হ্যাঁঃ- [ রাগে গজগজ করিতে করিতে বৃদ্ধের প্রস্থান ]
[ পাশের এক বাড়ির জানলা খুলিয়া আর এক বৃদ্ধের হসিমুখ বাহির করণ ]
বৃদ্ধ :   কি হে ? এত তর্কাতর্কি কিসের ?
পথিক :   আজ্ঞে না, তর্ক নয় । আমি জল চাইছিলুম, তা উনি সে কথা কানেই নেন না- কেবলই সাত পাঁচ গপ্‌‌প করতে লেগেছেন । তাই বলতে গেলুম ত রেগে মেগে অস্থির !
বৃদ্ধ :   আরে দূর দূর ! তুমিও যেমন ! জিজ্ঞেস করবার আর লোক পাওনি ? ও হতভাগা জানেই বা কি, আর বলবেই বা কি ? ওর যে দাদা আছে, খালিপুরে চাকরি করে, সেটা ত একটা গাধা । ও মুখ্যুটা কি বললে তোমায় ?
পথিক :   কি জানি মশাই- জলের কথা বলতেই কুয়োর জাল, নদীর জাল, পুকুরের জল, কলের জল, মামাবাড়ির জল, ব'লে পাঁচ রকম ফর্দ শুনিয়ে দিলে-
বৃদ্ধ :   হুঁঃ ‒ ভাবলে খুব বাহাদুরি করেছি । তোমায় বোকা মতন দেখে খুব চাল চেলে নিয়েছে । ভারি ত ফর্দ করেছেন । আমি লিখে দিতে পারি, ও যদি পাঁচটা জল বলে থাকে তা আমি এক্ষুনি পঁচিশটা বলে দেব-
পথিক :   আজ্ঞে হ্যাঁ । কিন্তু আমি বলছিলুম কি একটু খাবার জল‒
বৃদ্ধ :   কি বলছ ? বিশ্বাস হচ্ছে না ? আচ্ছা শুনে যাও । বিষ্টির জল, ডাবের জল, নাকের জল, চোখের জল, জিবের জল, হুঁকোর জল, ফটিক জল, রোদে ঘেমে জ-ল, আহ্লাদে গলে জ‒ল, গায়ের রক্ত জ‒ল, বুঝিয়ে দিলে যেন জ-ল ‒ কটা হয় ? গোনোনি বুঝি ?
পথিক :   না মশাই, গুনিনি‒ আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই‒
বৃদ্ধ :   তোমার কাজ না থাকলেও আমাদের কাজ থাকতে পারে ত ? যাও, যাও, মেলা বকিও না । ‒একেবারে অপদার্থের একশেষ ! [ সশব্দে জানলা বন্ধ ]
পথিক :   নাঃ, আর জলটল চেয়ে কাজ নেই‒ এগিয়ে যাই, দেখি কোথাও পুকুরটুকুর পাই কি না ।
[ লম্বা লম্বা চুল, চোখে সোনার চশমা, হাতে খাতা পেন্সিল, পায়ে কটকী জুতা, একটি ছোকরার প্রবেশ ]
লোকটা নেহাৎ‌ এসে পড়েছে যখন, একটু জিজ্ঞাসাই করে দেখি । মশাই, আমি অনেক দূর থেকে আসছি, এখানে একটু জল মিলবে না কোথাও?
ছোকরা :   কি বলছেন ? 'জল' মিলবে না ? খুব মিলবে । একশোবার মিলবে ! দাঁড়ান, এক্ষুনি মিলিয়ে দিচ্ছি‒ জল চল তল বল কল ফল ‒ মিলের অভাব কি ? কাজল-সজল-উজ্জ্বল জ্বলজ্বল-চঞ্চল চল্‌‌ চল্‌‌ , আঁখিজল ছল্‌‌ছল্‌‌ , নদীজল কল্‌‌কল্‌‌ , হাসি শুনি খল্‌‌খল্‌‌sঅ্যাঁকানল বাঁকানল, আগল ছাগল পাগল‒ কত চান ?
পথিক :   এ দেখি আরেক পাগল ! মশাই, আমি সে রকম মিলবার কথা বলিনি ।
ছোকরা :   তবে কি রকম মিল চাচ্ছেন বলুন ? কি রকম, কোন ছন্দ, সব বলে দিন‒ যেমনটি চাইবেন তেমনটি মিলিয়ে দেব ।
পথিক :   ভালো বিপদেই পড়া গেল দেখছি‒ (জোরে) মশাই ! আর কিছু চাইনে, ‒(আরো জোরে)sশুধু একটু জল খেতে চাই !
ছোকরা :   ও বুঝেছি । শুধু-একটু-জল-খেতে-চাই । এই ত ? আচ্ছা বেশ । এ আর মিলবে না কেন ?‒ শুধু একটু জল খেতে চাই ‒ভারি তেষ্টা প্রাণ আই-ঢাই । চাই কিন্তু কোথা গেলে পাই‒বল্‌‌ শীঘ্র বল্‌‌ নারে ভাই । কেমন ? ঠিক মিলেছে ত ?
পথিক :   আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব মিলেছে‒খাসা মিলেছে‒ নমস্কার । (সরিয়া গিয়া) নাঃ, বকে বকে মাথা ধরিয়ে দিলে‒ একটু ছায়ায় বসে মাথাটা ঠাণ্ডা কনে নি । [একটা বাড়ির ছায়ায় গিয়া বসিল]
ছোকরা :   (খুশী হ‌‌ইয়া লিখিতে লিখিতে) মিলবে না ? বলি, মেলাচ্ছে কে ? সেবার যখন বিষ্টুদাদা 'বৈকাল' কিসের সঙ্গে মিল দেবে খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন 'নৈপাল' বলে দিয়েছিল কে ? নৈপাল কাকে বলে জানেন ত ? নেপালের লোক হল নৈপাল । (পথিককে না দেখিয়া) লোকটা গেল কোথায় ? দুত্তোরি ! [প্রস্থান]
[ বাড়ির ভিতরে বালকের পাঠ‒ পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল । সমুদ্রের জল লবণাক্ত, অতি বিস্বাদ ]
পথিক :   ওহে খোকা ! একটু এদিকে শুনে যাও ত ?
[ রুক্ষমুর্তি, মাথায় টাক, লম্বা দাড়ি খোকার মামা বাড়ি হ‌‌ইতে বাহির হ‌‌ইলেনs]
মামা :   কে হে ? পড়ার সময় ডাকাডাকি করতে এয়েছ?‒ (পথিককে দেখিয়া) ও ! আমি মনে করেছিলুম পাড়ার কোন ছোকরা বুঝি । আপনার কি দরকার?
পথিক :   আজ্ঞে , জল তেষ্টায় বড় কষ্ট পাচ্ছি‒ তা একটু জলের খবর কেউ বলতে পারলে না ।
মামা :   (তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা খুলিয়া) কেউ বলতে পারলে না ? আসুন, আসুন । কি খবর চান, কি জানতে চান, বলুন দেখি ? সব আমায় জিজ্ঞেস করুন, আমি বলে দিচ্ছি । [ ঘরের মধ্যে টানিয়া ল‌‌ওন‒ ভিতরে নানারকম যন্ত্র, নকশা, রাশি রাশি ব‌‌ই ]
কি বলছিলেন ? জলের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন না?
পথিক :   আজ্ঞে হ্যাঁ, সেই সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছি‒
মামা :   আ হা হা ! কি উৎ‌সাহ ! শুনেও সুখ হয় । এ রকম জানবার আকাঙ্খা কজনের আছে, বলুন ত? বসুন ! বসুন ! [ কতকগুলি ছবি, ব‌‌ই আর এক টুকরা খড়ি বাহির করিয়া ] জলের কথা জানতে গেলে প্রথমে জানা দরকার, জল কাকে বলে, জলের কি গুণ‒
পথিক :   আজ্ঞে, একটু খাবার জল যদি‒
মামা :   আসছে‒ ব্যস্ত হবেন না । একে একে সব কথা আসবে । জল হচ্ছে দুই ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেন‒ [ বোর্ডে খড়ি দিয়া লিখিলেন ]
পথিক :   এই মাটি করেছে !
মামা :   বুঝলেন? রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জলকে বিশ্লেষণ করলে হয়‒ হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন । আর হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের রাসায়নিক সংযোগ হলেই হল জল ! শুনছেন ত?
পথিক :   আজ্ঞে হ্যাঁ, সব শুনছি । কিন্তু একটু খাবার জল যদি দেন, তাহলে আরো মন দিয়ে শুনতে পারি ।
মামা :   বেশ ত ! খাবার জলের কথাই নেওয়া যাক না । খাবার জল কাকে বলে ? না, যে জল পরিস্কার, স্বাস্থকর, যাতে দুর্গন্ধ নাই, রোগের বীজ নাই‒ কেমন ? এই দেখুন এক শিশি জল‒ আহা, ব্যস্ত হবেন না । দেখতে মনে হয় বেশ পরিস্কার, কিন্তু অনুবীক্ষন দিয়ে যদি দেখেন, দেখবেন পোকা সব কিলবিল করছে । কেঁচোর মতো, কৃমির মতো সব পোকা‒ এমনি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুবীক্ষন দিয়ে দেখায় ঠিক এত্তো বড় বড় । এই বোতলের মধ্যে দেখুন, ও বাড়ির পুকুরের জল; আমি এইমাত্র পরীক্ষা করে দেখলুম; ওর মধ্যে রোগের বীজ সব গিজ্‌‌গিজ্‌‌ করছে‒ প্লেগ, ট‌‌ইফয়েড, ওলাউঠা, ঘেয়োজ্বর ‒ও জল খেয়েছেন কি মরেছেন ! এই ছবি দেখুন‒ এইগুলো হচ্ছে কলেরার বীজ, এই ডিপথেরিয়া, এই নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া ‒সব আছে । আর এই সব হচ্ছে জলের পোকা‒ জলের মধ্যে শ্যাওলা ময়লা যা কিছু থাকে ওরা সেইগুলো খায় । আর এই জলটার কি দুর্গন্ধ দেখুন ! পচা পুকুরের জল‒ ছেঁকে নিয়েছি, তবু গন্ধ ।
পথিক :   উঁ হুঁ হুঁ হুঁ ! করেন কি মশাই ? ওসব জানবার কিচ্ছু দরকার নেই‒
মামা :   খুব দরকার আছে । এসব জানতে হয়‒ অত্যন্ত দরকারী কথা !
পথিক :   হোক দরকারী‒ আমি জানতে চাইনে, এখন আমার সময় নেই‒
মামা :   এই ত জানবার সময় । আর দুদিন বাদে যখন বুড়ো হয়ে মরতে বসবেন, তখন জেনে লাভ কি ? জলে কি কি দোষ থাকে, কি করে সে সব ধরতে হয়, কি করে তার শোধন হয়, এসব জানবার মতো কথা নয় ? এই যে সব নদীর জল সমুদ্রে যাচ্ছে, সমুদ্রের জল সব বাস্প হয়ে উঠছে, মেঘ হচ্ছে, বৃষ্টি পড়ছে‒ এরকম কেন হয়, কিসে হয়, তাও ত জানা দরকার?
পথিক :   দেখুন মশাই ! কি করে কথাটা আপনাদের মাথায় ঢোকাব তা ত ভেবে পাইনে। বলি, বারবার করে বলছি‒ তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, সেটা ত কেউ কানে নিচ্ছেন না দেখি। একটা লোক তেষ্টায় জল-জল করছে তবু জল খেতে পায় না, এরকম কোথাও শুনেছেন?
মামা :   শুনেছি বৈকি‒ চোখে দেখেছি । বদ্যিনাথকে কুকুরে কামড়াল, বদ্যিনাথের হল হাইড্রোফোবিয়া‒ যাকে বলে জলাতঙ্ক। আর জল খেতে পারে না‒ যেই জল খেতে যায় অমনি গলায় খিঁচ ধরে যায়। মহা মুশকিল !‒ শেষটায় ওঝা ডেকে, ধুতুরো দিয়ে ওষুধ মেখে খওয়ালো, মন্তর চালিয়ে বিষ ঝাড়ল‒ তারপর সে জল খেয়ে বাঁচল। ওরকম হয়।
পথিক :   নাঃ‒ এদের সঙ্গে আর পেরে ওঠা গেল না‒ কেন‌‌ই বা মরতে এসেছিলাম এখেনে? বলি, মশাই, আপনার এখানে নোংরা জল আর দুর্গন্ধ জল ছাড়া ভালো খাঁটি জল কিছু নেই?
মামা :   আছে বৈকি! এই দেখুন না বোতলভরা টাটকা খাঁটি 'ডিস্টিল ওয়াটার'‒ যাকে বলে 'পরিশ্রুত জল' ।
পথিক :   (ব্যস্ত হ‌‌ইয়া) এ জল কি খায়?
মামা :   না, ও জল খায় না‒ ওতে স্বাদ নেই‒ একেবারে বোবা জল কিনা, এইমাত্র তৈরি করে আনল‒ এখনো গরম রয়েছে।
[ পথিকের হতাশ ভাব ]
তারপর যা বলছিলাম শুনুন‒ এই যে দেখছেন গন্ধওয়ালা নোংরা জল‒ এর মধ্যে দেখুন এই গোলাপী জল ঢেলে দিলুম‒ বাস, গোলাপী রঙ উড়ে শাদা হয়ে গেল । দেখলেন ত?
পথিক :   না মশাই, কিচ্ছু দেখিনি‒ কিচ্ছু বুঝতে পারিনি‒ কিচ্ছু মানি না‒ কিচ্ছু বিশ্বাস করি না।
মামা :   কি বললেন ! আমার কথা বিশ্বাস করেন না?
পথিক :   না, করি না। আমি যা চাই, তা যতক্ষণ দেখাতে না পারবেন, ততক্ষণ কিচ্ছু শুনব না, কিচ্ছু বিশ্বাস করব না।
মামা :   বটে ! কোনটা দেখতে চান একবার বলুন দেখি‒ আমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি‒
পথিক :   তাহলে দেখান দেখি । শাদা, খাঁটি চমৎ‌কার, ঠাণ্ডা, এক গেলাশ খাবার জল নিয়ে দেখান দেখি । যাতে গন্ধপোকা নেই, কলেরার পোকা নেই, ময়লাটয়লা কিচ্ছু নেই, তা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখান দেখি । খুব বড় এক গেলাশ ভর্তি জল নিয়ে আসুন ত।
মামা :   এক্ষুনি দেখিয়ে দিচ্ছি‒ ওরে ট্যাঁপা, দৌড়ে আমার কুঁজো থেকে এক গেলাশ জল নিয়ে আয় ত।
[ পাশের ঘরে দুপদাপ শব্দে খোকার দৌড় ]
নিয়ে আসুক তারপর দেখিয়ে দিচ্ছি । ঐ জলে কি রকম হয়, আর এই নোংরা জলে কি রকম তফাৎ‌ হয়, সব আমি এক্সপেরিমেন্ট করে দেখিয়ে দিচ্ছি।

[ জল ল‌‌ইয়া ট্যাঁপার প্রবেশ ]
রাখ এইখানে রাখ।
[ জল রাখিবামাত্র পথিকের আক্রমণ‒ মামার হাত হ‌‌ইতে জল কাড়িয়া এক নিঃশ্বাসে চুমুক দিয়া শেষ ]
পথিক :   আঃ ! বাঁচা গেল !
মামা :   (চটিয়া) এটা কি রকম হল মশাই?
পথিক :   পরীক্ষা হল‒ এক্সপেরিমেন্ট ! এবার আপনি নোংরা জলটা একবার খেয়ে দেখান ত, কি রকম হয়?
মামা :   (ভীষণ রাগিয়া) কি বললেন !
পথিক :   আচ্ছা থাক, এখন নাই বা খেলেন‒ পরে খবেন এখন । আর এই গাঁয়ের মধ্যে আপনার মতো আনকোরা পাগল আর যতগুলো আছে, সব কটাকে খানিকটা করে খা‌‌ইয়ে দেবেন । তারপর খাটিয়া তুলবার দরকার হলে আমার খবর দেবেন‒ আমি খুশী হয়ে ছুটে আসব‒ হতভাগা জোচ্চোর কোথাকার !  [ দ্রুত প্রস্থান ]
[ পাশের গলিতে সুর করিয়া কে হাঁকিতে লাগিল‒ 'অবাক জলপান' ]

Read More...

গ্যালিলিও (Galileo)

সে সাড়ে তিনশত বৎসর আগেকার কথা। ইটালি দেশে পিসা নগরে সম্ভ্রান্ত বংশে গ্যালিলিও-র জন্ম হয়। গ্যালিলিওর পিতা অঙ্কশাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন, শিল্প সংগীত প্রভৃতি নানা বিদ্যায় তাঁহার দখল ছিল। কিন্তু তবু সংসারে তাঁহার টাকা পয়সার অভাব লাগিয়াই ছিল। সুতরাং তিনি ভাবিলেন, পুত্রকে এমন কোন বিদ্যা শিখাইবেন, যাহাতে ঘরে দুপয়সা আসিতে পারে। স্থির হইল, গ্যালিলিও চিকিৎসা শিখিবেন।

কিন্তু বাল্যকাল হইতেই গ্যালিলিওর মনের ঝোঁক অন্যদিকে। ডাক্তারি বই পড়ার চাইতে তিনি কলকব্জা লইয়া নাড়াচাড়া করিতেই বেশি ভালবাসিতেন। সকলে বলিত, "ওসব শিখিয়া লাভ কি? যাহাতে প্যসা হয় তাই শিখিতে চেষ্টা কর।" উনিশ বৎসর বয়সে একদিন ঘটনাক্রমে জ্যামিতি বিষয়ে এক বক্তৃতা শুনিয়া, গ্যালিলিও সেইদিন হইতেই জ্যামিতি শিখিতে লাগিয়া গেলেন। কিন্তু বেশিদিন তাঁহার কলেজে পড়া হইল না। তাঁহার পিতার দুরবস্থা ক্রমে বাড়িয়া শেষটায় এমন হইল যে, তিনি আর পড়ার খরচ দিতে পারেন না। কলেজের কর্তারাও দেখিলেন, এ ছোকরা নিজের পরাশুনার চাইতে জ্যামিতি ও অন্যান্য 'বাজে' বইয়েতেই বেশি সময় নষ্ট করে। বুঝাইতে গেলে উল্টা তর্ক করে, আপনার জেদ ছাড়িতে চায় না। সুতরাং গ্যালিলিওর কলেজে টেকা দায় হইল। তিনি বাড়িতে ফিরিয়া আবার অঙ্কশাস্ত্রে মন দিলেন। তারপর পঁচিশ বৎসর বয়সে অনেক চেষ্টার পর, তিনি মাসিক ষোল টাকা বেতনে সামান্য এক মাস্টারির চাকরী লইলেন।

কিন্তু এক চাকরীও তাঁহার বেশিদিন টিকিল না। কেন টিকিল না, সে এক অদ্ভুত কাহিনী। সে সময়ে লোকের ধারণা ছিল, এবং পণ্ডিতেরাও এইরূপ বিশ্বাস করিতেন যে, যে-জিনিস যত ভারি, শূন্যে ছাড়িয়া দিলে সে তত তাড়াতাড়ি মাটিতে পড়ে। গ্যালিলিও একটা উঁচু চূড়া হইতে নানারকম জিনিস ফেলিয়া দেখাইলেন যে, একথা মোটেও সত্য নয়। সব জিনিসই ঠিক সমান হিসাবে মাটিতে পড়ে। তবে, কাগজ পালক প্রভৃতি নিতান্ত হালকা জিনিস যে আস্তে আস্তে পড়ে তার কারন এই যে, হালকা জিনিসকে বাতাসের ধাক্কায় ঠেলিয়া রাখে। ঠিক কিরকমভাবে জিনিস কত সেকেন্ডে কতখানি পড়ে, তাহারও তিনি চমৎকার হিসাব বাহির করিলেন। কিন্তু এত বড় আবিষ্কারে লোকে খুশি না হইয়া বরং সকলে গ্যালিলিওর উপর চটিয়া গেল। পণ্ডিতেরা পর্যন্ত গ্যালিলিওর হিসাব প্রমাণ কিছু না দেখিয়াই সব আজগুবি বলিয়া উড়াইয়া দিলেন। এবং তাহার ফলে ঘোর তর্ক উঠিয়া গ্যালিলিওর চাকরীটি গেল।

যাহা হউক অনেক চেষ্টায় গ্যালিলিও আবার একটি চাকরী জোগাড় করিলেন এবং কয়েক বৎসর একরূপ শান্তিতে কাটাইলেন। কিন্তু বিনা গোলমালে চুপচাপ করিয়া থাকা তাঁহার স্বভাব ছিল না। ১৬০৪ খৃষ্টাব্দে ৪০ বৎসর বয়েসে তিনি কোপার্নিকাসের মত সমর্থন করিয়া তুমুল তর্ক তুলিলেন। কোপার্নিকাসের পূর্বে লোকে বলিত, "পৃথিবী শূন্যে স্থির আছে—সূর্য গ্রহ চন্দ্র তারা সব মিলিয়া তাহার চারিদিকে ঘুরেতেছে।" কোপার্নিকাস যখন বলিলেন যে, 'পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে' তখন লোকে তাঁহার কথা গ্রাহ্য করে নাই। সুতরাং গ্যালিলিও যখন আবার সেই মত প্রচার করিতে আরম্ভ করিলেন, তখন আবার একটা হৈ চৈ পড়িয়া গেল। সে সময়কার পণ্ডিতেরা প্রায় সকলেই গ্যালিলিওর বিরুদ্ধে—কিন্তু গ্যালিলিও একাই তেজের সহিত তর্ক চালাইয়া সকলকে নিরস্ত করিতে লাগিলেন।

এই সময়ে গ্যালিলিও দূরবীক্ষণের আবিষ্কার করেন। হল্যান্ড দেশের এক চশমাওয়ালা কেমন করিয়া দুইখানা কাচ লইয়া আন্দাজে পরীক্ষা করিতে গিয়া দৈবাৎ একটা দূরবীক্ষণ বানাইয়া ফেলে। এই সংবাদ ক্রমে ইটালি পর্যন্ত ছড়াইয়া পড়িল; গ্যালিলিও শুনিলেন যে, একরকম যন্ত্র বাহির হইয়াছে, তাহাতে দূরের জিনিস খুব নিকটে দেখা যায়। শুনিয়াই তিনি ভাবিতে বসিলেন এবং রাতারাতি জিনিসটার সংকেত বাহির করিয়া নিজেই একটা দূরবীণ বানাইয়া ফেলিলেন। হল্যান্ডের চশমাওয়ালাটি দূরবীণ দিয়া দূরের ঘরবাড়ি দেখিয়াই সন্তুষ্ট ছিল, গ্যালিলিও তাহাকে আকাশের দিকে ফিরাইলেন।
দূরবীনে আকাশ দেখিয়া তাঁহার মনে কি যে আনন্দ হইল, সে আর বলা যায় না। তিনি যেদিকে দূরবীণ ফিরান, যাহা কিছু দেখিতে যান সবই আশ্চর্য দেখেন। চাঁদের উপর দূরবীণ কষিয়া দেখা গেল, তার সর্বাঙ্গে ফোস্কা! কোন জন্মের সব আগ্নেয় পাহাড় তার সারাটি গায়ে যেন চাক বাঁধিয়া আছে। বৃহস্পতিকে দেখা গেল একটা চ্যাপ্টা গোলার মতো—তার আবার চার চারটি চাঁদ। সূর্যের গায়ে কালো কালো দাগ! ছায়াপথের ঝাপ্‌সা আলোয় যেন হাজার হাজার তারার গুঁড়া ছড়াইয়া আছে। শুক্রগ্রহ যে ঠিক আমাদের চাঁদের মতো বাড়ে কমে, দূরবীণে তাহাও ধরা পড়িল। এমনি করিয়া গ্যালিলিও কত যে আশ্চর্য ব্যাপার দেখিতে লাগিলেন তাহার আর শেষ নাই। অবশ্য এসব কথাও লোকে বিশ্বাস করিতে চাহিল না—কোন কোন পণ্ডিত গ্যালিলিওর সঙ্গে তর্ক করিতে আসিয়া, তাঁহার দূরবীণ দেখিয়া তবে সব বিশ্বাস করিলেন। কেহ কেহ সব দেখিয়াও বলিলেন, "ওসব কেবল দেখার ভুল—চোখে ধাঁধা লাগিয়া ঐরূপ দেখায়—আসলে আকাশে ওরকম কিছু নাই।" একজন পণ্ডিত দূরবীণ দিয়া বৃহস্পতির চাঁদ দেখিতে সাফ অস্বীকার করিলেন।

ক্রমে কথাটা গুরুতর হইয়া উঠিল। লোকে বলিতে লাগিল গ্যালিলিও এইরকম ভাবে যা-তা প্রচার করিতে থাকিলে লোকের ধর্মবিশ্বাস আর টিকিবে না। পৃথিবী স্থির হইয়া আছে, এ কথাই যদি লোকে বিশ্বাস না করে তবে কিসে তাহারা বিশ্বাস করিবে? স্বয়ং ধর্মগুরু পোপ আদেশ দিলেন, "তুমি এই সকল জিনিস লীয়া বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করিও না। তোমার যা বিশ্বাস, তা তোমারই থাক। তাহা লইয়া যদি লোকের মনে নানারকম সন্দেহ জন্মাইতে যাও, তবে ভাল হইবে না।" গ্যালিলিও বুঝিলেন যে 'ভাল হইবে না' কথাটার অর্থ বড় সহজ নয়। নিজের প্রাণটি বাঁচাইতে হইলে আর গোলমাল না করাই ভাল। কয়েক বৎসর গ্যালিলিও চুপ করিয়া রহিলেন—অর্থাৎ ঐ বিষয়ে চুপ করিয়া রহিলেন। কিন্তু তাঁহার মনের রাগ ও ক্ষোভ গেল না। কিছুদিন জোয়ার ভাঁটা ধূমকেতু ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা করিয়া, তিনি আবার সেই পৃথিবী ঘোরার কথা লইয়া নাড়াচাড়া আরম্ভ করিলেন। কিন্তু এবারে 'পৃথিবী ঘোরে' একথা স্পষ্টভাবে না বলিয়া, তিনি তাঁহার বিরুদ্ধদলকে নানারকমে ঠাট্টা বিদ্রূপ করিয়া সকলকে ক্ষেপাইয়া তুলিলেন। তখন পাদ্রির দল তাঁহার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনিল যে, গ্যালিলিও ধর্মগুরু পোপকে অপমান করিয়াছেন। অভিযোগটা সম্পূর্ণ মিথ্যা, কিন্তু পাদ্রিদের ধর্ম্বিচার সভায় গ্যালিলিওর উপর তাঁহার সমস্ত কথা ফিরাইয়া লাইবার হুকুম হইল—না হইলে প্রাণদণ্ড। গ্যালিলিওর বয়স তখন প্রায় ৭০ বৎসর। অনেক অত্যাচারের পর তিনি তাঁহার কথা ফিরাইয়া লইলেন। সভায় সকলের সম্মুখে বলিলেন, "আমি যাহা শিক্ষা দিয়াছি, তাহা ভুল বলিয়া স্বীকার করিলাম।" কিন্তু মুখে একথা বলিলেও তাঁহার মন তাহা মানিল না—তিনি পাশের একটি বন্ধুকে দৃঢ়তার সহিত বলিলেন, "আস্বীকার করিলে হইবে কি? এই পৃথিবী এখনও চলিতেছে।"

এইরূপে নিজের জীবনের উপার্জিত সমস্ত সত্যকে অস্বীকার করিয়া, তিনি মনের ক্ষোভে ভগ্নদেহে বাড়ি ফিরিয়া গেলেন। তারপর যে কয়েক বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন, তাঁহাকে আর বাহিরে কোথাও বড় দেখা যাইত না। নিজে সারাজীবন সাধনা করিয়া যাহা সত্য বুঝিয়াছেন, তাহা প্রাণ খুলিয়া প্রচার করিতে পারিলেন না, এই দুঃখ লইয়াই তাঁহার জীবন শেষ হইল। যদি গ্যালিলিও জানিতেন আজ জগতের লোকে তাঁহার শিক্ষা এমন সম্মান ও শ্রদ্ধার সহিত গ্রহণ করিবে, তবে বোধহয় বৃদ্ধের শেষ জীবন এত কষ্টের হইত না।
Read More...

বুদ্ধিমানের সাজা - Buddhimaner Saja

আলি শাকালের মত ওস্তাদ আর ধূর্ত নাপিত সে সময়ে মেলাই ভার ছিল। বাগদাদের যত বড় লোক তাকে দিয়ে খেউড়ী করাতেন, গরিবকে সে গ্রাহ্যই করত না।

একদিন এক গরীব কাঠুরে ঐ নাপিতের কাছে গাধা বোঝাই ক'রে কাঠ বিক্রী করতে এল। আলি শাকাল কাঠুরেকে বলল, "তোমার গাধার পিঠে যত কাঠ আছে সব আমাকে দাও; তোমাকে এক টাকা দেব।" কাঠুরে তাতেই রাজী হয়ে গাধার পিঠের কাঠ নামিয়ে দিল। তখন নাপিত বলল, "সব কাঠ তো দাও নি; গাধার পিঠের 'গদি'টা কাঠের তৈরী; ওটাও দিতে হবে।" কাঠুরে তো কিছুতেই রাজী হলো না; কিন্তু নাপিত তার আপত্তি গ্রাহ্য না ক'রে গদিটা জবরদস্তি ক'রে কেড়ে নিয়ে, কাঠুরেকে এক টাকা দিয়ে বিদায় করে দিল।

কাঠুরে বেচারা আর কি করে? সে গিয়ে খালিফের কাছে তার নালিশ জানাল। খালিফ বললেন, "তুমি তো 'গাধার পিঠের সমস্ত কাঠ' দিতে রাজী ছিলে; তবে আর এখন আপত্তি করছ কেন? কথামতই তো কাজ হয়েছে।" তারপর কাঠুরের কানে ফিস্‌ ফিস্‌ ক'রে কি জানি বললেন; কাঠুরেও মুচ্‌কি হেসে, "যো হুকুম" বলে সেলাম ঠুকে চলে গেল।

কিছুদিন বাদে কাঠুরে আবার নাপিতের কাছে এসে বলল, "নাপিত সাহেব, আমি আর আমার সঙ্গীকে খেউড়ী করার জন্য তোমাকে ১০ টাকা দেব, তোমার মত ওস্তাদের হাতে অনেক বেশি টাকা দিয়েও খেউড়ী হ'তে পারলে জন্ম সার্থক হয়। তুমি কি রাজী আছ?" নাপিত তো খোসামোদে ভুলে, কাঠুরেকে কামিয়ে চট্‌পট্‌ দিল; তারপর তাকে বলল, "কৈ হে তোমার সঙ্গী?" কাঠুরে তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে তার গাধাটি এনে হাজির করল। নাপিত তো বেজায় চটে গিয়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে, ঘুষি বাগিয়ে বলল, "এত বড় বেয়াদবি আমার সঙ্গে! সুলতান, খালিফ, আগা, বেগ যার হাতে খেউড়ী হবার জন্য সর্বদাই খোসামোদ করে, সে কিনা গাধাকে কামাবে! বেরোও এখনি এখান থেকে!"

কাঠুরে নাপিতের কথার কোন উত্তর না দিয়ে সটান গিয়ে খালিফের কাছে হাজির। খালিফ তার নালিশ শুনে আলি শাকালকে ডেকে পাঠালেন। নাপিত এসেই হাত জোড় করে বলল, "দোহাই ধর্মাবতার! গাধাকে কি কখনও মানুষের সঙ্গী ব'লে ধরা যেতে পারে?" খালিফ বললেন, "তা' না হ'তেও পারে, কিন্তু গাধার পিঠের গদিও কি কখনও কাঠের বোঝার মধ্যে ধরা যেতে পারে? তুমিই একথার জবাব দাও।" নাপিত তো একেবারে চুপ! কিছুক্ষণ বাদে খালিফ বললেন, "আর দেরি কেন? গাধাকে কামিয়ে ফেল; কথা-মত কাজ না করতে পারলে তার উচিত সাজার ব্যবস্থা হবে জানই তো।" নাপিত বেচারা আর করে কি? গাধাকে বেশ ক'রে খুর বুলিয়ে কামাতে লাগল। সে তামাসা দেখবার জন্য চারিদিকে ভিড় জমে গেল। কামান শেষ হতেই নাপিত অপমানে মাথা হেঁট ক'রে বাড়ি পালাল। কাঠুরেও নেড়া গাধায় চ'ড়ে নাচ্‌তে নাচ্‌তে বাড়ি পালাল।

Read More...

Tuesday, July 23, 2013

অতীতের ছবি (Atiter Chobi)

পর্ব ১

ছিল এ ভারতে এমন দিন
মানুষের মন ছিল স্বাধীন ;
সহজ উদার সরল প্রাণে
বিস্ময়ে চাহিত জগত পানে।
আকাশে তখন তারকা চলে,
নদী যায় ভেসে, সাগর টলে,
বাতাস ছুটিছে আপন কাজে,
পৃথিবী সাজিছে নানান সাজে ;
ফুলে ফলে ছয় ঋতুর খেলা,
কত রূপ কত রঙের মেলা;
মুখরিত বন পাখির গানে,
অটঁল পাহাড় মগন ধ্যানে;
নীলকাশে গন মেঘের ঘটাঁ,
তাহে ইন্দ্রধনু বিজলী ছঁটা,
তাহে বারিধারা পড়িছে ঝরি-
দেখিত মানুষ নয়ন ভরি।
কোথায় চলেছে কিসের টানে
কোথা হতে আসে, কেহ না জানে।
ভাবিত মানব দিবস-যামী,
ইহারি মাঝারে জাগিয়া আমি,
কিছু নাহি বুঝি কিছু নাহি জানি,
দেখি দেখি আর অবাক মানি।
কেন চলি ফিরি কিসের লাগি
কখন ঘুমাই কখন জাগি,
কত কান্না হাসি দুখে ও সুখে
ক্ষুধা তৃষ্ণা কত বাজিছে বুকে।
জন্ম লভি জীব জীবন ধরে,
কোথায় মিলায় মরণ পরে?
ভবিতে ভাবিতে আকুল প্রাণে
ডুবিত মানব গভীর ধ্যানে।
অকূল রহস্য তিমিরতলে,
জ্ঞানজ্যোতিময় প্রদীপ জ্বলে,
সমাহিত চিতে যতন করি
অচঞ্চল শিখা সে আলো ধরি
দিব্য জ্ঞানময় নয়ন লভি,
হেরিল নতুন জগত ছবি।
অনাদি নিয়মে অনাদি স্রোতে
ভাসিয়া চলেছে অকুল পথে
প্রতি ধুলিকণা নিখিল টানে
এক হতে ধায় একেরি পানে,
চলেছে একেরি শাসন মানি,
লোকে লোকান্তরে একেরি বাণী
এক সে অমৃতে হয়েছে হারা
নিখিল জীবন-মরণ ধারা।
সে অমৃতজ্যোতি আকাশ ঘেরি,
অন্তরে বাহিরে অমৃত হেরি।
যাঁহা হতে জীব জনম লভে,
যাহা হতে ধরে জীবন সবে,
যাহার মাঝারে মরণ পরে
ফিরি পুন সবে প্রবেশ করে,
তাহার জানিবে যতন ধরি।
তিনি ব্রহ্ম তারে প্রনাম করি।
আনন্দেতে জীব জনম লভে
আনন্দে জীবিত রয়েছে সবে;
আনন্দে বিরাম লভিয়া প্রাণ
আনন্দের মাঝে করে প্রয়াণ।
শুন বিশ্বলোক শুনহ বাণী
অমৃতের পুত্র সকল প্রাণী,
দিব্যধামিবাসী শুনহ সবে-
জেনেছি তাহারে, যিনি এ ভবে
মহান পুরুষ নিখিল গতি,
তমসার পরে পরম জ্যোতি :
তেজোময় রূপে হেরিয়া তাঁরে
স্তব্ধ হয় মন, বচন হারে।
বামে ও দখিনে উপরে নীচে,
ভিতরে বাহিরে সমুখে পিছে,
কিবা জলেস্থলে আকাশ পরে
আধারে আলোকে চেতনে জড়ে:
আমার মাঝারে আমারে ঘেরি
এক ব্রহ্মময় প্রকাশ হেরি।
সে আলোকে চাহি আপন পানে
আপনারে মন স্বরূপ জানে।
আমি আমি করি দিবস- যামী,
না জানি কেমন কোথা সে আমি
অজর অমর অরূপ রূপ
নহি আমি এই জড়ের স্তুপ
দেহ নহে মোর চির-নিবাস
দেহের বিনাশে নাহি বিনাশ।
বিশ্ব আত্মা মাঝে হয়ে মগন
আপন স্বরূপ হেরিলে মন
না থাকে সন্দেহ না থাকে ভয়
শোক তাপ মোহে নিমেষে লয়,
জীবনে মরণে না রহে ছেদ,
ইহা পরলোকে না রহে ভেদ।
ব্রহ্মানন্দময় পরম ধাম,
হেথা আসি সবে লভে বিরাম;
পরম সম্পদ পরম গতি,
লভ তাঁরে জীব যতনে অতি।

পর্ব ২

কালচক্রে হায় এমন দেশে
ঘোর দুঃখদিন আসিল শেষে।
দশদিকে হতে আঁধার আসি
ভারত আকাশ ফেলিল গ্রাসি।
কোথা সে প্রাচীন জ্ঞানের জ্যোতি,
সত্য অন্বেষণে গভীর মতি ;
কোথা ব্রহ্মজ্ঞান সাধন ধন,
কোথা ঋষিগণ ধ্যানে মগন;
কোথা ব্রহ্মচারী তাপস যত,
কোথা সে ব্রাহ্মণ সাধনা রত?
একে একে সবে মিলাল কোথা,
আর নাহি শুনি প্রাচীন কথা।
মহামূল্য নিধি ঠেলিয়া পায়
হেলায় মানুষ হারাল তায়।
আপন স্বরূপ ভুলিয়া মন
ক্ষুদ্রের সাধনে হল মগন।
ক্ষুদ্র চিন্তা মাঝে নিয়ত মজি,
ক্ষুদ্র স্বার্থ-সুখ জীবনে ভাজি;
ক্ষুদ্র তৃপ্তি লয়ে মূঢ়ের মত
ক্ষুদ্রের সেবায় হইল রত।
রচি নব নব বিধি-বিধান
নিগড়ে বাঁধিল মানব প্রাণ;
সহস্র নিয়ম নিষেধ শত ;
তাহে বদ্ধ নর জড়ের মত ;
লিখি দাসখত ললাটে তার
রুদ্ধ করি দিল মনের দ্বার।
জ্বলন্ত যাঁহার প্রকাশ ভাবে-
হায়রে তাঁহারে ভুলিল সবে;
কল্পনার পিছে ধাইল মন,
কল্পিত দেবতা হল সৃজন,
কল্পিত রূপের মূরতি গড়ি,
মিথ্যা পূজাচার রচন করি,
ব্যাখ্যা করি তার মহিমা শত,
মিথ্যা শাস্ত্রবাণী রচিল কত।
তাহে তৃপ্ত হয়ে অবোধ নরে
রহে উদাসীন মোহের ভরে।
না জাগে জিজ্ঞাসা অলস মনে,
দেখিয়া না দেখে পরম ধনে।
ব্রাহ্মণেরে লোকে দেবতা মানি
নির্বিচারে শুনে তাহারি বাণী।
পিতৃপুরুষের প্রসাদ বরে
বসি উচ্চাসনে গরব ভরে
পূজা-উপচার নিয়ত লভি
ভুলিল ব্রাহ্মণ নিজ পদবী।
কিসে নিত্যকালে এ ভারতভাবে
আপন শাসন অঁটুট রবে-
এই চিন্তা সদা করি বিচার
হল স্বার্থপর হৃদয় তার।
ভেদবুদ্ধিময় মানব মন
নব নব ভেদ করে সৃজন।
জাতিরে ভাঙিয়া শতধা করে,
তাহার উপরে সমাজ গড়ে;
নানা বর্ণ নানা শ্রেণীবিচার ,
নানা কুটবিধি হল প্রচার।
ভেদ বুদ্ধি কত জীবন মাঝে
অশনে বসেন সকল কাজে,
ধর্ম অধিকারে বিচার ভেদ
মানুষে মানুষে করে প্রভেদ।
ভেদ জনে জনে, নারী ও নরে,
জাতিতে জাতিতে বিচার ঘরে।
মিথ্যা অহংকারে মোহের বশে
জাতির একতা বাঁধন খসে:
হয়ে আত্মঘাতী ভারতভবে
আপন কল্যণ ভুলিল সবে।

পর্ব ৩

এখনও গভীর তমসা রাতি,
ভারত ভবনে নিভিছে বাতি -
মানুষ না দেখি ভারতভূমে,
সবাই মগন গভীর ঘুমে।
কত জাতি আজ হেলার ভরে
হেথায় আসিয়া বসতি করে।
ভারতের বুকে নিশান গাথি
বসেছে সবলে আসন পাতি।
নিজ ধনমান নিজ বিভব
বিদেশীর হাতে সঁপিয়া সব,
ভারতের মুখে না ফুটে বাণী,
মৌন রহে দেশ শরম মানি।
- হেনকালে শুন ভেদি আঁধার
সুগম্ভীর বানী উঠিল কার-
“ভাব সেই এক ভাবহ তারে,
জলে স্থলে শুন্যে হেরিছ যারে
নিয়ত যাহার স্বরূপ ধ্যানে
দিব্য জ্ঞান জাগে মানব প্রাণে।
ছাড় তুচ্ছ পূজা জড় সাধন,
মিথ্যা দেবসেবা ছাড়া এখন,
বেদান্তের বাণী স্মরণ কর,
ব্রহ্মজ্ঞান-শিখা হৃদয়ে ধর
সত্য মিথ্যা দেখে করি বিচার
খুলি দাও যত মনের দ্বার ।
মানুষের মত স্বাধীন প্রাণ
নির্ভয়ে তাকাও জগত পানে-
দিকে দিকে দেখ ঘুচিছে রাতি,
দিকে দিকে জাগে কত না জাতি;
দিকে দিকে লোক সাধনারত
জ্ঞানের ভান্ডার খুলেছে কত।
নাহি কি তোমার জ্ঞানের খনি ?
বেদান্ত রতন মুকুটমণি?
অসারে মজে কি ভুলেছ তুমি-
ধর্মে গরীয়ান ভারতভুমি?”
-শুনি মৃতদেশ পরান পায়,
বিস্ময়ে মানুষ ফিরিয়া চায়।
দেখে দিব্যরূপ পুরুষ বরে
কান্তি তেজোময় নয়ন হরে,
গবল শরীর সুঠাম অতি,
ললাট প্রসর, নয়নে জ্যোতি,
গম্ভীর স্বভাব,বচন ধীর,
সত্যের সংগ্রামে অজেয় বীর;
অতুল প্রখর প্রতিভা ধরে
নানা শাস্ত্র ভাষা বিচার করে।
রামমোহনের জীবন স্মরি,
কৃতজ্ঞতা ভরে প্রনাম করি।
দেশের দুর্গতি সকলখানে
হেরিয়া বাজিল রাজার প্রাণে ।
কত অসহায় অবোধ নারী
সতীত্বের নামে সকল ছাড়ি,
কেহ স্ব-ইচছায়, কেহবা ভয়ে,
শাসনে তাড়নে পিষিত হয়ে,
পতির চিতায় পুড়িয়া মরে-
শুনি কাদে প্রাণ তাদের তরে ।
নারীদুঃখ নাশ করিল পণ,
ঘুচিল নারীর সহমরণ ।
নিষ্কাম করম- যোগীর মত
দেশের কল্যাণ সাধনে রত,
নানা শাস্ত্রবাণী করে চয়ন,
দেশ দেশান্তের ঋষিবচন;
পশ্চিমের নব জ্ঞানের বাণী
দেশের সমুখে ধরিল আনি।
কিরূপেতে পুন এ ভারতভবে
ব্রহ্মজ্ঞান কথা প্রচার হবে ,
নিয়ত যতন তাহারি তরে,
কত শ্রম কত প্রয়াস করে ;
তর্ক আলোচনা কত বিচার
কত গ্রন্থ রচি’ করে প্রচার;
-ক্রমে বিনাশিতে জড় ধরম
‘ব্রহ্ম সমাজে’র হল জনম ।
শুনে দেশবাসি নুতন কথা,
মূরতিবিহীন পুজার প্রথা
উপাসনা -গৃহ দেখে নতুন-
যেথায় স্বদেশী বিদেশী জন
শুদ্র দ্বিজ আদি মিলিয়া সবে
নির্বিচারে সদা আসন লাভে।
মহাপুরুষের বিপুল শ্রমে
দেশে যুগান্তর আসিল ক্রমে।
স্বদেশের তার আকুল প্রাণ
প্রবাসেতে রাজা করে প্রয়ান;
সেথায় সুদুর বিলাতে হায়
অকালেতে রাজা ত্যজিল কায়।
অসমাপ্ত কাজ রহিল পড়ে,
ফিরে যায় লোকে নিরাশা ভরে;
একে একে সব যেতেছে চলে-
ভাসে রামচন্দ্র নয়নজলে।
রাজার জীবন নিয়ত স্মরি’
উপাসনা গৃহে রহে সে পড়ি,
নিয়ম ধরিয়া পূজার কালে
নিষ্ঠাভাবে সেথা প্রদীপ জ্বালে।
একা বসি ভাবে রাজার কাজ
এমন দুর্দিনে কে লবে আজ।

পর্ব ৪

ধনী যুবা এক শ্মশান ঘাটে
একা বসি তার রজনী কাটে।
অদূরে অন্তিম শয়নোপরি
দিদিমা তাহার আছেন পড়ি,
সম্মুখে পূর্ণিমা গগনতলে
পিছনে শ্মশানে আগুন জ্বলে,
তাহারি মাঝারে নদীর তীরে
হরিনাম ধ্বনি উঠিছে ধীরে।
একাকী যুবক বসিয়া কুলে
সহসা কি ভাবি আপনা ভুলে।
প্রসন্ন আকাশ চাঁদিম রাতি
ধরিল অপূর্ব নতুন ভাতি,
তুচ্ছ বোধ হল ধন – বিভব
বিলাস বাসনা অসার সব,
অজানা কি যেন সহসা স্মরি
পলকে পরান উঠিল ভরি।
আর কি সে মন বিরাম মানে?
গভীর পিপাসা জাগিল প্রাণে।
কোথা শান্তি পাবে ব্যাকুল তৃষা
শুধায় সবারে না পায় দিশা।
-সহসা একদা তাহার ঘরে
ছিন্নপত্র এক উড়িয়া পড়ে ;
কি যেন বচন লিখিত তায়
অর্থ তার যুবা ভাবি না পায়।
বিদ্যাবাগীশের নিকটে তবে
যুবা সে বাণীর মরম লভে-
“যাহা কিছু এই জগততলে
অনিত্যের স্রোতে ভাসিয়া চলে
রহ্মে আচ্ছাদিত জানিবে তায়-”
শুনিয়া যুবক প্রবোধ পায়।
শুনি মহাবাণী চমক লাগে,
আরো জানিব রে বাসনা জাগে
ব্রহ্মজ্ঞান লাভে পিপাসু মন
গভীর সাধনে হল মগন:
যত ডোবে আরো ডুবিতে চায়
ডুবি নব নব রতন পায়া।
হেনকালে হল অশনিপাত
যুবকের পিতা দ্বারকানাথ,
অতুল সম্পদ ধন বিভব
ঋণের পাথারে ডুবায়ে সব
কিছু না বুঝিতে জানিতে কেহ
অকালে সহসা ত্যজিল দেহ।
আত্মীয় -স্বজন কহিল সবে,
“যে উপায়ে হোক বাঁচিতে হবে-
কর অস্বীকার ঋণের দায়
নহিলে তোমার সকলি যায়।”
নাহি টলে তায় যুবার মন,
পিতৃঋণ শোধ করিল পণ,
হয়ে সর্বত্যাগী ফকির দীন
ছাড়ি দিল সব শোধিতে ঋণ।
উত্তমর্ণজনে অবাক মানি
কহে শ্রদ্ধাভারে অভয় বাণী,
“বিষয় বিভব থাকুক তব,
মোরা তাহা হতে কিছু না লব।
সাধুতা তোমার তুলনাহীন;
সাধ্যমত তুমি শোধিও ঋণ।”
বরষের পর বরষ যায়,
যুবক এখন প্রবীণ -প্রায়।
সংসারে বাসনা -বিগত মন,
ঋষি কল্পরুপ ধ্যানে মগ্ন,
ব্রহ্ম-ধ্যান -জ্ঞানে পুরিত প্রান ,
ব্রহ্মানন্দ রস করিছে পান;
বচনেতে যেন অমৃত ঝরে-
নমি নমি তাঁরে ভকতি ভরে।
ব্রাহ্মসমাজে আসন হতে
দীপ্ত অগ্নিয় বচন স্রোতে
ব্রহ্মজ্ঞান ধারা বহিয়া যায়,
কত শত লোকে শুনিতে ধায়।
“ব্রহ্মে কর প্রীতি নিয়ত সবে,
প্রিয়কার্য় তাঁর সাধহ ভবে।
হের তারে নিজ হৃদয় মাঝে,
সেথা ব্রজ্যেতি নিয়ত রাজে।
জ্ঞান সমুজ্জল বিমল প্রাণে ,
যে জানে তাহারে ধ্রুব সে জানে ।
জানিবার পথ নাহিক আর,
নহে শাসত্র বাণী প্রমান তাঁর ।
বহু তর্ক বহু বিচার বলে
বহু জপ তপ সাধন ফলে
বহু তত্ত্বকথা আলোড়ি চিতে
নাহি পায় সেই বচনাতীতে।”
ব্রহ্ম সমাজের অসাড় প্রাণে ,
মহর্ষির বানী চেতনা আনে।
দলে দলে লোক সেথায় ছোটে
ঊৎসাহের স্রোতে আসিয়া জোটে।
মত্ত অনুরাগে কেশব ধায়,
প্রতিভার জ্যোতি নয়নে ভায়;
আকুল আগ্রহে পরান খুলি
ঝাঁপ দিল স্রোতে আপনা ভুলি।
হেরি মহর্ষির পুলক বাড়ে
“ব্রহ্মনন্দ” নাম দিলেন তারে ।
লভি নব প্রানে সমাজ কায়
নব নব ভাবে বিকাশ পায় ;
ধর্ম গ্রন্থ নব,নব সাধন,
ব্রহ্ম উপাসনা বিধি নূতন
ধর্মপ্রান কত নারী ও নরে
তাহে নিমগন পুলক ভরে ।

পর্ব ৫

সমাজে সুদিন এল আবার,
ক্রমে প্রসারিল জীবন তার।
কেশব আপন প্রতিভা বলে
যতনে গঠিল যুবকদলে।
নগরে নগরে হল প্রচার-
"ধর্ম রাজ্যে নাহি জাতিবিচার;
নাহি ভেদ হেথা নারী ও নরে,
ভক্তি আছে যার সে যায় ত'রে।
জাতিবর্ণ- ভেদ কুরীতি যত
ভাঙি দাও চিরদিনের মত।
দেশ দেশান্তরে ধাঊক মন,
সর্বধর্মবাণী কর চয়ন;
ধর্মে ধর্মে নাহি বিরোধ রবে,
মহা সমম্বয় গঠিত হবে।"
পশিল সে বাণী দেশের প্রাণে,
মুগ্ধ নরনারী অবাক মানে ।
নগরে নগরে তুফান উঠে,
ঘরে ঘরে কত বাঁধন টুটে;
ব্রহ্ম নামে সবে ছুটিয়া চলে,
প্রাণ হতে প্রাণে আগুন জ্বলে।
আসিল গোঁসাই ব্যাকুল হয়ে
প্রেমে ভরপূর ভকতি লয়ে।
আসিল প্রতাপ স্বভাব ধীর,
গম্ভীর বচন জ্ঞানে গভীর।
স্বল্পভাষী সাধু অঘোরনাথ
যোগমগ্ন মন দিবসরাত।
গৌরগোবিন্দের সাধক প্রাণ
হিন্দুশাস্ত্রে তাঁর অতুল জ্ঞান।
কান্তিচন্দ্র সদা সেবায় রত
সেবাধর্ম তাঁর জীবন-ব্রত।
ত্রৈলোক্যনাথের১০ সরস গান
নব নব ভাবে মাতায় প্রাণ।
আরো কত সাধু ধরমমতি
বঙ্গচন্দ্র১১ আদি প্রচার-ব্রতী
একসাথে মিলি প্রেমের ভরে
প্রেমপরিবার গঠন করে।
কাল কিবা খাবে কেহ না জানে,
আকুল উৎসাহ সবার প্রাণে ।
নূতন মন্দির নব সমাজ
নব ভাবে কত নূতন কাজ।
দিনে দিনে নব প্রেরণা পায়,
উৎসাহের স্রোত বাড়িয়া যায়।
সমাজ-চালনা বিধি-বিচার
কেশবের হাতে সকল ভার;
কেশবপ্রেরণা সবার মূলে
তাঁর নামে সবে আপনা ভুলে।
ধন্য ব্রহ্মানন্দ যাঁহার বাণী
শিরে ধরে লোকে প্রমাণ মানি।
যাঁহার সাধনা আজিও হেরি
রয়েছে সমাজ জীবন ঘেরি ;
যাঁহার মূরতি স্মরণ করি,
যাঁহার জীবন হৃদয়ে ধরি,
শত শত লোক প্রেরণা পায়-
আজি ভক্তিভরে প্রণমি তাঁয়।
আবার বহিল নূতন ধারা,
সমাজের প্রাণে বাজিল সাড়া;
ভাসি বহুজনে সে নব স্রোতে
বাহির হাইল নূতন পথে।
মিলি অনুরাগে যতন ভরে
এই "সাধারণ" সমাজ গড়ে।
ওদিকে কেশব নূতন বলে
বাঁধিল আবার আপন দলে।
নব ভাবে "নববিধান" গড়ি,
নূতন সংহিতা রচনা করি,
ভগ্নদেহ লয়ে অবশপ্রায়,
খাটিতে খাটিতে ত্যজিল কায়।

পর্ব ৬

ধরি নব পথ নূতন ধারা
নবীন প্রেরণে আসিল যারা,
আজি তাঁহাদের চরণ ধরি
ভক্তিভরে সবে স্মরণ করি।
শাস্ত্রী শবনাথ সকল ফেলি
বিষয় বাসনা চরণে ঠেলি
বহু নির্যাতন বহিয়া শিরে,
অনুরাগে ভাসি নয়ন নীরে,
সর্বত্যাগী হয়ে ব্যাকুল প্রাণে
ছুটে আসে ওই কিসের টানে,
দেখ ওই চলে পাগলমত
ভক্তশ্রেষ্ট বীর বিনয়নত,
বিজয় গোঁসাই সরল প্রাণ-
হেরি আজি তাঁই প্রেম বয়ান।
সাধু রামতনু১২ জ্ঞানে প্রবীণ,
শিশুর মতন চির নবীন।
শিবচন্দ্র দেব সুধীর মন,
কর্মনিষ্ঠাময় সাধু জীবন ।
নগেন্দ্রনাথের১৩ যুকতি বানে
কূট তর্ক যত নিমেষে হানে ।
আনন্দমোহন১৪ মুরতি যার।
উমেশচন্দ্রের১৫ জীবণ মন ,
নীরব সাধনে সদা মগন।
দুর্গামোহনের১৬ জীবনগত
সমাজের সেবা দানের ব্রত।
দ্বারকানাথের১৭ স্মরন হয়
ন্যায়ধর্মে বীর অকুতোভয় ।
পূর্ব বঙ্গে হোথা সাধক কত
নবধর্ম বানী প্রচারে কত।
সংসারে নিলিপ্ত ভাবুক প্রাণ
স্বার্থক প্রচারে কালীনারা'ণ১৮
কত নাম কব কত যে জ্ঞানী
কত ভক্ত সাধু যোগী ও ধ্যানী;
কত মধুময় প্রেমিক মন
আড়ম্বহীন সেবকজন ;
আসিল হেথায় আকাশ ভরে
সবার যতনে সমাজ গড়ে।
এই যে মন্দির হেরিছ যার
ইটকাঠ ময় স্থুল আকার ;
ইহারি মাঝারে কত যেস্মৃতি,
কত আকিঞ্চন সমাজ প্রীতি,
ব্যাকুল ভাবনা দিবস রাত
বিনিদ্র সাধনে জীবন পাত ।
বহু কর্মময় এই সমাজ
সে সব কাহিনী না কব আজ,
আজিকে কেবল স্মরণে আনি
ব্রাহ্মসমাজের মহান বাণী ।
যে বাণী শুনুনু রাজার মুখে,
মহর্ষি যাহারে ধরিল বুকে,
কেশব যে বাণী প্রচার কারে-
স্মরি আজ তাহা ভকতি ভরে।
রক্তাক্ষরে লিখা যে বাণী রটে
এই সমাজের জীবনপটে-
“স্বাধীন মানবহৃদয়তলে
বিবেকের শিখা নিয়ত জ্বলে।
গুরুর আদেশ সাধুর বাণী
ইহার উপরে কারে না মানি?”
স্বাধীন মানে এই সমাজ
মুক্ত ধর্মলাভে ইহার কাজ।
হেথায় সকল বিরোধ গুচি
রবে নানা মত নানান্ রুচি
কাহারো রচিত বিধি বিধান
রুধিবে না হেথা কাহারো প্রাণ।
প্রতি জীবনের বিবেক ভাতি
সবার জীবনে জ্বলিবে বাতি।
নর নারী হেথা মিলিয়া সবে
সম অধিকারে আসন লাভে।
প্রেমেতে বিশাল জ্ঞানে গভীর
চরিত্রে সংযত করমে বীর ;
ঈশ্বরে ভক্তি মানবে প্রীতি,
হেথা মানুষের জীবন নীতি।
ফুরাল কি সব হেথায় আসি ?
আসিবে না প্রেম জড়তা নাশি?
জাগিবে না প্রাণ ব্যাকুল হয়ে,
নব নব বাণী জীবনে লয়ে ?
জ্বলিবে না নব সাধন শিখা ?
নব ইতিহাস হবে না লিখা ?
চিররুদ্ধ রবে পুজার দ্বার ?
আসিবে না নব পুজারী আর ?
কোথাও আশার আলো কি নাহি ?
শুধাই সবার বদন চাহি।


১ রামমোহন রায়   ২ রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ   ৩ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর   ৪ কেশবচন্দ্র সেন   ৫ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী   ৬ প্রতাপচন্দ্র মজুমদার   ৭ অঘোরনাথ গুপ্ত   ৮ গৌরগোবিন্দ রায়   ৯ কান্তিচন্দ্র মিত্র   ১০ ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল   ১১ বঙ্গচন্দ্র রায়   ১২ রামতনু লাহিড়ী   ১৩ নগেন্দ্রনাথ চট্যোপাধ্যায়   ১৪ আনান্দমোহন বসু   ১৫ উমেশচন্দ্র দত্ত   ১৬ দূর্গামোহন দাস   ১৭ দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়   ১৮ কালীনারায়ণ রায়
Read More...